যে মানুষটি ভারতের ক্ষুধাকে পরাজিত করেছিলেন — এম. এস. স্বামীনাথনের সবুজ বিপ্লবের মহাকাব্য

 


চ্যানেল ইলেভেন | নিউজ ডেস্ক রিপোর্ট | প্রলয় চ্যাটার্জি

ভারতের অন্নদাতা এম. এস. স্বামীনাথন: এক বিজ্ঞানীর হাত ধরেক্ষুধা থেকে স্বাধীনতা

যে মানুষটি ভারতের ক্ষুধাকে পরাজিত করেছিলেন — এম. এস. স্বামীনাথনের সবুজ বিপ্লবের মহাকাব্য

সালটা ছিল ১৯৬৫।

দিল্লির উপকণ্ঠের ছোট্ট গ্রাম জাউনতি। রৌদ্রের মধ্যে ধুলো উড়ছে, মাঠে ঘাম ঝরাচ্ছেন কৃষকরা। এমনই এক রবিবারে, এক প্রবীণ চাষি নিজের কড়া পড়া হাত বাড়িয়ে দিলেন এক অতিথি বিজ্ঞানীর দিকে, ডক্টর সাহেব, আমরা আপনার বীজ নেব,” বলেছিলেন তিনি।

সেই বিজ্ঞানী ছিলেন . এম. এস. স্বামীনাথন , পরবর্তীতেভারতের সবুজ বিপ্লবের জনকনামে যিনি খ্যাতি অর্জন করেন। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বলেছিল “Godfather of the Green Revolution”, এবং বিংশ শতকের প্রভাবশালী ভারতীয়দের মধ্যে গান্ধী রবীন্দ্রনাথের পাশে স্থান দিয়েছিল তাঁর নাম।

১৯৬৩ সালে স্বামীনাথন মেক্সিকোর কৃষিবিজ্ঞানী নরম্যান বোরলগ-কে রাজি করান ভারতের জন্য উচ্চ ফলনশীল গমের জাত পাঠাতে। তিন বছর পর, ভারত আমদানি করেছিল ১৮,০০০ টন বীজ। স্বামীনাথন ভারতীয় আবহাওয়ার উপযোগী করে সেগুলোর সংকরায়ণ করেন, তৈরি করেন সোনালি আভাযুক্ত গমযা স্থানীয় জাতের তুলনায় দ্বিগুণ ফলন দিত এবং রোগ-পোকার প্রতিরোধ ক্ষমতাও ছিল বেশি।

কিন্তু এই বিপ্লবের পথ একেবারেই সহজ ছিল না। সরকারি দপ্তরের আমলাতান্ত্রিক জট, আমদানির ধীরগতি, কৃষকদের অবিশ্বাসসব বাধা পেরিয়ে স্বামীনাথন নিজেই মাঠে গিয়ে বীজ বিলিয়েছিলেন। পাঞ্জাবে বন্দিদের দিয়ে বীজের প্যাকেট সেলাই করিয়েছিলেন যাতে সময়মতো বপন করা যায়।

যে মানুষটি ভারতের ক্ষুধাকে পরাজিত করেছিলেন — এম. এস. স্বামীনাথনের সবুজ বিপ্লবের মহাকাব্য

মেক্সিকান লালচে গমকে ভারতীয় রুচির সঙ্গে মানানসই করতে তিনি বানালেন সোনালি দানার জাত,  কাল্যাণ সোনা সোনালিকা। সেই সোনালি গমই পরবর্তীতে পাঞ্জাব হরিয়ানাকে বানায় ভারতের অন্নভাণ্ডার।

মাত্র চার বছরের মধ্যে১৯৭১ নাগাদভারত ফসল উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। দুর্ভিক্ষের দেশ থেকে খাদ্য-উৎপাদনে শক্তিশালী রাষ্ট্রে রূপান্তর ঘটে। যেন বিজ্ঞানের হাত ধরে এক জাতির পুনর্জন্ম।

. স্বামীনাথনের দর্শন ছিল সরল,  “চাষিই প্রকৃত বিজ্ঞানী।তিনি বলতেন, “বিজ্ঞানী যদি শুনতে না জানে, সে সমাধান দিতে পারবে না।তাই প্রতিটি সাপ্তাহিক ছুটিতে তিনি গ্রামের মাঠে যেতেন, চাষিদের সঙ্গে বসে কথা বলতেন মাটির আর্দ্রতা, বীজের দাম, কীটপতঙ্গ, আর ফসলের গল্প নিয়ে।

ওড়িশায় আদিবাসী নারীদের নিয়ে তিনি উন্নত ধানের জাত উদ্ভাবন করেছিলেন, তামিলনাডুর শুষ্ক অঞ্চলে লবণসহিষ্ণু ফসল প্রচলন করেছিলেন। পাঞ্জাবে জমিদারদের বলেছিলেন, বিজ্ঞান একা ক্ষুধা মেটাতে পারবে না, বিজ্ঞানের সঙ্গে দরকার সহানুভূতি।

২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ন্যাশনাল কমিশন অন ফার্মার্স-এর চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট পেশ করেন, যা আজও ভারতের কৃষিনীতি গঠনে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কৃষক আত্মহত্যার পেছনের আর্থিক সংকট, জমির ক্ষুদ্রতা, এবং ফসলের দামের বৈষম্য তিনি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন।

৯৮ বছর বয়সেও তিনি কৃষকদের পাশে ছিলেন২০২১ সালে পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষক আন্দোলনে তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন জানান।

তাঁর প্রভাব ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি উত্তর কোরিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খাদ্য নিরাপত্তায় বিপুল অবদান রাখেন।

যে মানুষটি ভারতের ক্ষুধাকে পরাজিত করেছিলেন — এম. এস. স্বামীনাথনের সবুজ বিপ্লবের মহাকাব্য

কিন্তু তিনি জানতেন, অতিরিক্ত রাসায়নিক চাষের ভয়ানক দিকও আছে। তাই নব্বইয়ের দশকে তিনি দিলেন নতুন ডাক,  “Evergreen Revolution” বা চিরসবুজ বিপ্লবেরফলন বাড়বে, কিন্তু প্রকৃতি ধ্বংস হবে না  

নিজের জীবনের পুরস্কারের অর্থ তিনি দান করেছিলেন গ্রামের শিক্ষাবৃত্তিতে। নারী কৃষকের ক্ষমতায়নে ডিজিটাল সচেতনতার প্রচার করেছিলেন বহু আগে, যখনঅ্যাগ্রি-টেকশব্দটাই জনপ্রিয় হয়নি।

১৯২৫ সালে তামিলনাডুর কুম্ভকোনমে জন্ম নেওয়া এক সাধারণ কৃষক পরিবারে বড় হওয়া এই মানুষটি ১৯৪৩ সালের বেঙ্গল দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা দেখে ঠিক করেছিলেন, “চিকিৎসা একশো জীবন বাঁচায়, কৃষিবিজ্ঞান লাখো জীবন।

২০২৩ সালে, ৯৮ বছর বয়সে যখন তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন, তখন পিছনে রেখে গেলেন এমন এক উত্তরাধিকার, যা কোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে

ক্ষুধা থেকে স্বাধীনতা।

নবীন পট্টনায়েক যথার্থই বলেছেন,

স্বামীনাথনের উত্তরাধিকার আমাদের মনে করিয়ে দেয়ক্ষুধা থেকে মুক্তিই মানুষের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা।

শেষ কথা:

এম. এস. স্বামীনাথনের জীবন এক জীবন্ত প্রমাণতথ্য সহানুভূতি, বিজ্ঞান মানবতার মেলবন্ধনই পারে এক জাতিকে পুনর্জীবিত করতে। তাঁর হাতে শুধু গমের দানা নয়, ছিল ভারতের ভবিষ্যৎ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন